প্রকাশিত: ৮:৪২ অপরাহ্ণ, মার্চ ৪, ২০২৪
ওমর আবু কুওয়াইক গাজার নিজ বাড়ি থেকে এখন অনেক দূরে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় বাবা-মা ও বোনের মৃত্যুর পাশাপাশি নিজ হাতের একটি অংশ হারিয়েছিল ৪ বছর বয়সী শিশুটি।
তবে খানিকটা ভাগ্যবান বরা যেতে পারে শিশুটিকে। পরিবার ও অপরিচিতদের প্রচেষ্টায় ওমরকে গাজা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয়, যেখানে একটি কৃত্রিম হাতসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পায়। নিউ ইয়র্ক শহরে দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালিত একটি বাড়িতে ফুফুর সঙ্গে দিন কাটিয়েছে শিশু ওমর।
অবশেষে ফিলাডেলফিয়ার শ্রীনার্স চিলড্রেনস হাসপাতালে বুধবার কৃত্রিম হাত পায় এবং মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, ‘আমার বাহু সুন্দর।’
দুর্ভোগের সমুদ্রে এটি ওমর ও তার ফুফু মাহা আবু কুওয়াইকের জন্য অনুগ্রহের ছিটাফোটা মাত্র। তারা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ছিল। যারা এখনও গাজায় আটকে আছে তাদের জন্য দুঃখ ও হতাশা সব সময়ই অদূরে।
মাহা এ নিয়ে খুশি যে তিনি তার প্রিয় ভাইয়ের ছেলের জন্য এই ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। ওমরকে তিনি এখন নিজের চতুর্থ সন্তান বলে মনে করেন।
কিন্তু এটি তার জন্য খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। ওমরের সঙ্গে যাওয়া মানে গাজার দক্ষিণতম শহর রাফাহতে তাবু ক্যাম্পে নিজের স্বামী ও তিন কিশোর সন্তানকে রেখে যাওয়া। রাফাহসহ যেসব এলাকায় বেসামরিক লোকদের আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে এমন এলাকাগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালিয়েছে। মাহা জানেন, তিনি তার পরিবারকে আর কখনও দেখতে পাবেন না।
তিনি বলেছিলেন,‘আমার বাচ্চারা ওমরকে খুব ভালোবাসে। তারা আমাকে বলেছিল, আমরা আর শিশু নই। যাও, ওমরের চিকিৎসা হোক। এটি ওর জন্য সবচেয়ে ভালো এবং এটি ওর একমাত্র সুযোগ।’
তিনি বলেন, ওমর বেশ চটপটে এবং তার প্রকৌশলী বাবার মতোই বুদ্ধিমান ছিল। কিন্তু এখন প্রায়ই সে হাল ছেড়ে দেয় আর কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ওমরকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে সে ডান হাত ও বাম হাতের বাকি অংশ দিয়ে কান চেপে ধরে বলে, ‘আমি কথা বলতে চাই না।’
অবশেষে ওমর বলেছে,‘বিদ্যালয় ভালো ছিল এবং আমি প্রথম দিনেই খুশি ছিলাম।’ যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছিল সে। কিন্তু এখন আর বিদ্যালয়ে যেতে চায় না সে। সে এখন ফুফুর কাছ থেকে দূরে যেতে ভয় পায়।
যদিও নিউইয়র্কে উড়ে যাওয়ায় নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ওমর।
‘যখন আমি বড় হব, আমি পাইলট হতে চাই,’ ওমর বলছিল, ‘যাতে আমি মানুষকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে আসতে পারি।’
ওমরই গাজার প্রথম ফিলিস্তিনি শিশু যাকে গ্লোবাল মেডিকেল রিলিফ ফান্ডের অধীনে নেওয়া হয়েছিল। স্টেটেন আইল্যান্ড দাতব্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এলিসা মন্টান্টি, যুদ্ধ বা বিপর্যয়ে অঙ্গ হারানো শত শত বাচ্চাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে এক চতুর্থাংশ সময় কাটিয়েছেন।
কয়েক দশক ধরে চলে আসা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা ঘটে গত ৭ অক্টোবর। গাজার চারপাশে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে ইসরায়েলি সম্প্রদায়গুলোতে ঢুকে পড়ে হামাস। প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়।
পাল্টা জবাবে ইসরায়েল গাজাকে ধ্বংস করেছে। পাঁচ মাসের যুদ্ধে, গাজার ২.৩ মিলিয়ন লোকের মধ্যে ৮০ শতাংশ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার গাজায় মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে, ৭০ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে। নিহতদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নারী ও শিশু। ইসরায়েল বেসামরিক মৃত্যুর জন্য হামাসকে দায়ী করে বলেছে, সশস্ত্র বিদ্রোহীরা জনগণের মধ্যে কাজ করছে।
যুদ্ধ শুরুর ২ সপ্তাহ পর ওমর ও মাহা অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। ইসরায়েলি বিমান হামলায় ভবনগুলো মাটিতে মিশে যাওয়ার আগে তারা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
এই দুই পরিবার বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে থাকতে চলে যায়।
৬ ডিসেম্বর, নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ওমরের দাদা-দাদির বাড়িতে দুটি ইসরায়েলি বিমান হামলা চালায়। বিস্ফোরণে তার মুখের চামড়া উঠে যায়। বাম হাতের কনুইয়ের নিচ থেকে হারিয়ে ফেলে সে। পা ও ঘাড় পুড়ে যায়। বাবা-মা, ৬ বছর বয়সী বোন, দাদা-দাদি, দুই ফুফু এবং এক চাচাতো ভাইয়ের মৃত্যু হয়।
ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে ওমর। উদ্ধারকারীরা খনন করে যখন তার ছোট্ট দেহটি খুঁজে পায়, তখন তার শরীর রক্তাক্ত ছিল।
ইউএস-ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা রাহমা ওয়ার্ল্ডওয়াইডের ভাইস প্রেসিডেন্ট আদিব চৌকি বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছিল, গাজায় থাকার চেয়ে অন্য যেকোনো জায়গাই তার জন্য ভালো।’
গাজাবাসীর চলাচল সীমাবদ্ধ করে প্রতিদিন মাত্র কয়েক শতাধিক মানুষকে ওই অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে, যাদের বেশিরভাগেরই বিদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ২ হাজার ২৯৩ জন রোগী গাজা ত্যাগ করেছে। যাদের মধ্যে ১ হাজার ৪৯৮ জন আহত ও ৭৯৫ জন অসুস্থ। আর তাদের সঙ্গী হিসেবে ১ হাজার ৬২৫ জন গাজা ছেড়ে যেতে পেরেছেন। এখনও প্রায় ৮ হাজার রোগী বিদেশে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা।
ফিলিস্তিনি, ইসরায়েলি ও মিশরীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আদিব চৌকি ওমর এবং মাহা আবু কুওয়াইকের জন্য নতুন পাসপোর্ট এবং তাদের মিশরে যাওয়ার জন্য ইসরায়েলি নিরাপত্তা ছাড়পত্র পেয়েছেন। একটি অ্যাম্বুলেন্স তাদের সীমান্তে নিয়ে আসে, যেখানে সিনাই মরুভূমি দিয়ে একটি মিশরীয় অ্যাম্বুলেন্স তাদের নিয়ে আসে। ১৭ জানুয়ারি নিউ ইয়র্কে উড়ে যেতে ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের সবুজ বাতির জন্য মিশরীয় একটি হাসপাতালে কয়েক সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করছিল ওমর আর তার ফুফু। ফিলাডেলফিয়ার শ্রীনার্স চিলড্রেনস হাসপাতালে, ওমরের পায়ে পোড়ার জন্য স্কিন গ্রাফ্ট সার্জারি হয়েছিল। সে তার নতুন কৃত্রিম হাত পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে বুধবার সেটি দেখতে পেয়ে ধরতে হাত বাড়িয়ে দেয় আর দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, ‘আমার বাহু সুন্দর।’
ওমর ও তার ফুফু পরের দিন কায়রোর উদ্দেশে একটি বিমানে উঠেছিলেন। সঙ্গে তাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ও ছিলেন। স্থায়ী আবাস না হওয়া পর্যন্ত মিশরে তার বাড়িতেই থাকবেন তারা। মাহা আবু কুওয়াইক বলেন, ‘আমি প্রায় ঘুমাই না । আমি ওমরের কথা ভাবি এবং আমি আমার বাচ্চাদের কথা ভাবি । তারা সেখানে তাঁবুতে বসবাস করছে এখনো।’
খাদ্যের অভাব। ইসরায়েলের হাতে গাজার অবরোধ অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে অনাহারের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, তার পরিবার একটি তাঁবুতে ৪০ জনের সঙ্গে ভাগ করে থাকছে যা ঝড়-বৃষ্টি থেকে সামান্যই সুরক্ষা দেয়। আর একজন অসুস্থ হলে অসুখ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
যুদ্ধের কারণে গাজায় সেলফোন এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আবু কুওয়াইক ‘যখন নেটওয়ার্ক থাকে’ যোগাযোগ রাখে। মিশরে ফেরার পর ওমর এবং তার ফুফুর ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট; কেননা তাদের নির্বাসনে যেতে হতে পারে।আবু কুওয়াইকের জন্য, যদিও, ওমরের ফিরে যাওয়ার জন্য কোনো বাড়ি নেই। তিনি বলেন, ‘আমি কল্পনাও করতে পারি না, যে আমি গাজায় ফিরে যাব। তার জীবন কী হবে? কোথায় তার ভবিষ্যৎ?’
A Concern Of Positive International Inc
Mahfuzur Rahman Mahfuz Adnan
Published By Positive International Inc, 37-66, 74th Street Floor 2, Jackson Heights, New York 11372.
Phone : 9293300588, Email : info.shusomoy@gmail.com,
………………………………………………………………………..
Design and developed by Web Nest